ভোর থেকেই আকাশে মেঘ জমে আছে। ভেবেছিলাম মেঘ কেটে যাবে। সূর্য উঠবে। তা আর হলো না। সকাল না গড়াতেই বৃষ্টি শুরু হলো। মুষলধারে। জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দটা উপভোগ করছিলাম। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, সে সময়ের কথা। বৃদ্ধ এক স্যার আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তিনি মাঝে মাঝে গর গর করে ইংরেজি বলতেন। ক্লাসের কেউ বুঝল কি না-বুঝল, তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। মাঝেমধ্যে নতুন নতুন শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতেন। একদিন আমাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল তো Cats and dogs অর্থ কী?’
আমি বললাম, ‘এটা তো খুব সহজ স্যার। Cat শব্দের অর্থ বিড়াল, যেহেতু এখানে বহুবচন, তাই হবে বিড়ালগুলো। আর and শব্দের অর্থ এবং। dogs শব্দের অর্থ কুকুরগুলো। উত্তরটা হবে বিড়ালগুলো এবং কুকুরগুলো।’
আমার উত্তর শুনে স্যারের হাসি যেন আর থামছেই না। ইংরেজি প্রবাদ-প্রবচন তখনো পড়িনি। তাই স্যারের হাসির কারণটা ধরতে পারিনি। অবশ্যি ক্লাস সেভেনে ওঠার পর সে কারণটা ধরতে পেরেছিলাম।
ছোটবেলার কথা চিন্তা করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলতেই কানে ভেসে আসল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। ফারিস—তুই?’
‘রাতে ফোন করে না আসতে বলেছিলি?’
‘তাই বলে এত বৃষ্টিতে?’


ফারিস কোনও জবাব দিলো না। কেবল এক ফালি হাসি উপহার দিলো। শব্দবিহীন হাসি। ফারিস আমার ক্লাসমেট। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ছেলেটার সাথে আমার পরিচয়। মাঝারি গড়নের। বেশ ফর্সা। মাথার চুলগুলো পাতলা কিন্তু দাড়ি বেশ ঘন। দাঁতগুলো মুক্তার মতো। ফারিসের সবচেয়ে নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হলো তার হাসি। খুব সুন্দর মুচকি হাসতে পারে। কথা বলার সময় ঠোঁটের কোনায় একঝলক হাসি লেগে থাকে—সব সময়।
বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। পারবে না কেন? ও জানে প্রচুর। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার থেকে, অন্যান্য বই-ই বেশি পড়ে। সময় পেলেই বই নিয়ে পড়ে থাকে। টানা অনেক ক্ষণ পড়তে পারে। বই পড়ার প্রতি ওর আগ্রহ দেখে আমরা বলতাম, ‘ফারিস, তোকে আমরা বইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো।’ প্রচণ্ড তাক্বওয়াবান ছেলে। নামাজ, রোজা, যিকির আর ব্যক্তিগত আমলের ব্যাপারে খুবই সচেতন। সময়ের প্রতি সচেতনতার মাত্রাটা, আমাদের সকলের থেকে বেশি। তাই তো তুমুল বৃষ্টিতেও সে সময়মতো চলে এসেছে।


ফারিসকে বসতে দিয়ে, ভেতর থেকে তোয়ালেটা এনে বললাম, ‘ভিজে তো একেবারে চুপসে গেছিস। শরীরটা মুছে নে। নয়তো ঠান্ডা লাগবে।’
‘ভিজব না—বাইরে যে বৃষ্টি!’
‘কী খাবি?’
‘কিছু না।’
‘কিছু না মানে?’
‘কিছু না মানে—কিছু না।’
‘তুই বললেই হলো? মা খিচুড়ি রান্না করছেন, সরষের তেল দিয়ে। আজ আর তোকে ছাড়ছি না।’
‘কী যেন বলবি বলেছিলি?’
‘এত তাড়া কিসের?’
‘রাহাতের সাথে দেখা করতে যেতে হবে।’
ফারিস কথা দিয়ে কথা রাখেনি এমন উদাহরণ নেই। অগত্যা চলে যাবে বিধায়, আসল ব্যাপারটা ওকে খুলে বললাম। আমার ফুফাতো ভাই—আসিফ। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে বিবিএ করছে। কিছুদিন আগেও যে ছেলেটা নামাজে অবহেলা করত না, আজ সে সংশয়বাদীদের দলে নাম লেখাতে বসেছে। নাস্তিক লেখকের পাল্লায় পড়েছে। কোরআনকে তার কাছে আদিম বই মনে হয়। বিশ্বায়নের এই যুগে নাকি কোরআনের কোনও প্রয়োজন নেই। যে মানুষ রকেট বানাচ্ছে, কৃত্রিম উপগ্রহ বানাচ্ছে, সুপার কম্পিউটার বানাচ্ছে, সে মানুষ জীবনবিধানও নিজেই তৈরি করতে পারে। এ জন্যে কোরআনের ওপর নির্ভর করার দরকার নেই।
সব শোনার পর ফারিস বলল, ‘আসিফ আছে বাসায়?’
‘হ্যাঁ, আছে। কালই এসেছে।’
‘ওর সাথে কথা বলা যাবে?’
‘সে জন্যেই তো তোকে ডেকেছি। আমি ডাকছি। আসিফ! আসি—ফ! এই আসিফ! একটু শুনে যা তো।’

ভেতর থেকে আসিফ এল। ততক্ষণে চাও চলে এসেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফারিস বলল, ‘ভালো আছ, আসিফ?’
‘জি, ভালো।’
‘তুমি কোন ইয়ারে?’
‘সেকেন্ড ইয়ার।’
‘তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘এই তো, মোটামুটি।’
‘বই পড়তে কেমন লাগে—আসিফ?’
‘ভালো।’
‘হুমায়ুন আজাদের বই পড়েছ—আমার অবিশ্বাস?’
‘জি।’
‘তোমার সংশয় এ বই থেকেই তৈরি হয়েছে, তাই না?’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
ফারিস উত্তর দিলো না। বইটা সে আসিফের অনেক আগেই পড়েছে। শুধু এটাই না, নাস্তিকদের অনেক বই-ই সে পড়েছে।
‘আচ্ছা আসিফ, তুমি কি মাও সেতুং এর নাম শুনেছ?’, ফারিস পাল্টা প্রশ্ন করল।
আমি বুঝতে পারছিলাম না—আলোচনার মধ্যে হঠাৎ মাও সেতুং আসলো কেন? চুপ থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তাই নীরব শ্রোতার মতো শুনে যেতে লাগলাম।
ফারিসের প্রশ্নের জবাবে আসিফ বলল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি।’
‘তুমি কি জানো, মাও সেতুং-এর কারণে গণচীনে কী পরিমাণ লোক নিহত হয়েছিল?’
‘না ভাইয়া। আমার আইডিয়া নেই।’
‘তার নির্দেশে প্রায় দশ মিলিয়ন লোককে হত্যা করা হয়।’
দশ মিলিয়ন! সংখ্যাটা সত্যিই আমাকে অবাক করল। মানুষ কী করে এতটা হিংস্র হতে পারে? হাজার নয়, শত নয়—একেবারে মিলিয়ন! তাও আবার নিজের দেশের নাগরিক! মস্তিষ্ক কতটা বিকৃত হলে এমনটা কেউ করতে পারে! অবশ্যি যারা স্রষ্টাকেই অস্বীকার করে, তাদের কাছে তো এগুলো পানি-ভাত। ক্ষমতার জন্যে এরা মিলিয়ন কেন, এর থেকেও বেশি মানুষকে হত্যা করতে পারে।
ফারিস আরও বলল, ‘শুধু হত্যাই নয়, হত্যার পর তাদের দেহকে কেটে টুকরো টুকরো করা হতো। টুকরোগুলোকে রান্না করা হতো। তারপর পরিবারের সদস্যদের তা খাওয়ানো হতো—জোর করে। কোটি কোটি লোককে সে জেল খাটতে বাধ্য করে। জেলে বন্দী অবস্থায় মারা যায় প্রায় বিশ মিলিয়ন লোক। পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের কারণে প্রায় চল্লিশ মিলিয়ন লোক মারা যায়।’
হা করে আসিফ ফারিসের দিকে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপটা অবশ্যি হাতেই, চুমুক দিচ্ছে না। ফারিস আরেক চুমুক দিয়ে বলল, ‘বলতে পারবে আসিফ, জোসেফ স্ট্যালিনের নির্দেশে কী পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল?’
আসিফ না-সূচক মাথা নাড়ল। উত্তরটা তার জানা নেই। উত্তরটা ফারিসই দিলো।
‘স্ট্যালিন ছিলেন সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর কুখ্যাত নেতা, যিনি বিশ মিলিয়ন লোককে হত্যা করেন।’
‘বিশ মিলিয়ন!’ আসিফ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ ভাইয়া, বিশ মিলিয়ন। তুমি কি জানো, সমাজতন্ত্রীদের কারণে কী পরিমাণ লোক নিহত হয়েছিল?’
‘অনেক।’
‘অনেক নয়, ঠিকঠাক সংখ্যাটা বলো।’
‘সরি ভাইয়া। জানা নেই।’
‘The Black Book of Communism এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রায় এক শ মিলিয়ন লোক নিহত হয়—এদের কারণে।’
‘এক শ মিলিয়ন!’
‘হ্যাঁ ভাই, এক শ মিলিয়ন। আচ্ছা বলো তো আসিফ, তাদের এই কাজগুলো ঠিক ছিল, না ভুল?
‘অবশ্যই ভুল।’
‘কীভাবে বুঝলে?’
‘নিজের বিবেক দিয়ে।’
‘তাদের বিবেক অনুসারে?’
‘ঠিকই ছিল মনে হয়।’
‘তুমি তো অবশ্যই জানো—আমাদের দেশে মিনিস্কার্ট পরে বের হওয়াটা কী?’
‘অসভ্যতা।’
‘কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে?’
‘স্বাভাবিক।’
‘শুধু মিনিস্কার্ট নয়, ওদের কাছে বিকিনি পরে বের হওয়াটাও স্বাভাবিক। দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্র সৈকতে শরীরের ওপরের অংশ উলঙ্গ রাখাটাও স্বাভাবিক। আমেরিকার পশ্চিম সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যাওয়াটাও স্বাভাবিক।’

আসিফ চুপটি করে আছে। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা যেভাবে এক ধ্যানে কার্টুন দেখে থাকে, আসিফের তাকানোটাও ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। ফারিস এবার তাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা আসিফ, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আমাদের যুদ্ধকে তুমি কীভাবে দেখো?’
‘এটা মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতার লড়াই।’
‘হ্যাঁ, এটা মুক্তিযুদ্ধ। জালিমের সাথে মজলুমের লড়াই। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে?’
আসিফ এবারও কিছু বলল না। তার মানে উত্তরটা তার জানা। ফারিস বলল, ‘তাহলে বল তো আসিফ, বিবেক দিয়ে সবকিছু যাচাই করাটা কি ঠিক হবে?’
‘কেন, ভুল হবে কেন?’
‘বিবেক দিয়ে তো সব সময় ভালো-মন্দ নির্ধারণ করতে পারবে না।’
‘কেন পারব না? না পারার কী আছে?’
‘তোমার বিবেকের কাছে যেটা ঠিক মনে হবে, অন্যের কাছে সেটা ঠিক নাও হতে পারে। যেমন ধরো—সমকামিতা। তুমি এটাকে কীভাবে দেখো?’
‘ইট’স এ ক্রাইম।’
‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। এটা ক্রাইম। আমাদের বিবেকের কাছে এটা ক্রাইম। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ কিংবা অভিজিৎ রায়দের কাছে? ওদের কাছে এটা ক্রাইম না। সাধারণ একটি কাজ। কেবল বিবেক দিয়ে তুমি ভালো মন্দের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে পারবে না।’
‘তাহলে কি, অন্য কিছুর মাধ্যমে ভালো মন্দের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে হবে?’
‘হ্যাঁ ভাই। ঠিক তা-ই। ভালো-মন্দ নির্ধারণের জন্যে শুধু বিবেকই যথেষ্ট নয়। প্রত্যেকের বিবেক কখনো একটি কাজকে স্বাভাবিক মনে করতে পারে না। একেক জনের বিবেক একেক রকম হয়ে থাকে। একেক জন একেক দিক থেকে চিন্তা করে। একেক জন একেক দিক থেকে বিচার করে।
তোমার বিবেকের কাছে মিনিস্কার্ট পরে বের হওয়াটা অন্যায়, কিন্তু জাপানীদের চোখে তা স্বাভাবিক। তোমার কাছে নগ্ন হয়ে স্নান করাটা অন্যায়, কিন্তু পশ্চিমাদের চোখে তা স্বাভাবিক। তোমার কাছে মাও সেতুং কিংবা স্ট্যালিনের কাজগুলো সন্ত্রাসবাদ, কিন্তু তাদের কাছে তা স্বাভাবিক। তাই বিবেককে যদি ভালো-মন্দের স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়, তাহলে অবশ্যই সমস্যার সৃষ্টি হবে।’
‘আচ্ছা ভাই। এমন কিছু মানুষ যদি এ স্ট্যান্ডার্ড বানায়—যারা বিশ্বস্ত, সৎ, অধিক জ্ঞানী; তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
‘তবুও এই সমস্যা রয়েই যাবে।’
‘কেন?’
‘কোনও বিশেষ দেশ যদি এ স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে, তাহলে অন্য দেশে তা চলবে না। কোনও বিশেষ সমাজ যদি এ স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে, তাহলে আরেক সমাজে সেটা চলবে না। কোনও বিশেষ শতাব্দীতে যদি এ স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়, তাহলে আরেক শতাব্দীতে তা চলবে না। তুমি যেমন পশ্চিমাদের তৈরি স্ট্যান্ডার্ড মানবে না, তারাও তোমারটা মানবে না। তুমি যেমন নগ্নবাদীদের স্ট্যান্ডার্ড ফলো করবে না, তারাও তোমারটা ফলো করবে না। তুমি যেমন সমকামীদের স্ট্যান্ডার্ড মেনে নেবে না, তারাও তোমারটা মানবে না।’

আসিফ চুপ। একেবারে চুপ। এক ধ্যানে ফারিসের কথা শুনে যাচ্ছে। ফারিস আবার বলল, ‘স্ট্যান্ডার্ড বিধান কখনো বিবেক দিয়ে ঠিক করা যায় না। মানুষের বিবেক অনেক ক্ষেত্রেই প্রবৃত্তির কাছে নতি স্বীকার করে। ফলে মানুষ খারাপ কাজকেও ভালো মনে করতে থাকে। ভালোকেও খারাপ মনে করতে থাকে। আর মানুষকে যদি স্ট্যান্ডার্ড বিধান বানানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়, তো চিরকালই একদল মানুষের হাতে গোটা পৃথিবী জিম্মি থাকবে।’
আসিফের মাথায় হয়তো বিষয়টা ভালোভাবে ঢুকছে না। তাই আমি আসিফকে বললাম, ‘কিরে শুনছিস তো, ফারিস কী বলছে?’
আসিফ বলল, ‘লাস্টের পয়েন্টটা একটু ব্যাখ্যা করবেন প্লিজ?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তোমাকে একটি সহজ উদাহরণ দিচ্ছি, খেয়াল করো। মার্কিন সরকারের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন Terrorism এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছে—“কোনও সাধারণ নাগরিক বা সরকারকে ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে ব্যক্তি বা সম্পদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা বা সহিংসতার বেআইনি ব্যবহার করা।” FBI এর সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে—ব্যক্তি বা ক্ষমতার বেআইনি ব্যবহার করলে তা সন্ত্রাসী কাজ। কিন্তু যদি তার আইনি ব্যবহার হয়, তাহলে তা সন্ত্রাস নয়। এখন সমস্যা হলো, এই আইন ও বেআইন নিয়ে।
মার্কিন সরকার সাম্রাজ্যবাদকে ছড়িয়ে দিতে অসহায়, নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে দিনের পর দিন হত্যা করে যাচ্ছে। এটা তাদের আইন অনুসারে বৈধ। কিন্তু ওই সমস্ত দেশগুলোর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে এসব সম্পূর্ণ অবৈধ। ইরাক যুদ্ধের কথাই ধরো। মার্কিন সরকারের আইন অনুসারে তা বৈধ। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা সন্ত্রাসবাদ। মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাহলে এই সংজ্ঞায় অপরাধী নির্ণয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই তুমি যদি মানুষকে স্ট্যান্ডার্ড বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দাও, তাহলে এ রকম সমস্যায় পড়তে হবে।’
‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, স্ট্যান্ডার্ড বিধান একমাত্র স্রষ্টা তৈরি করবে?’
‘হ্যাঁ ভাই। আমি সেটাই বলতে চাচ্ছি। স্ট্যান্ডার্ড বিধান আমাদের স্রষ্টা তৈরি করবে।’
‘কেন?’
‘কারণ তিনি সকল প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে। সমস্ত দোষত্রুটি হতে পবিত্র। মহান স্রষ্টার অদৃশ্যের জ্ঞান আছে, আমাদের নেই। তিনি জানেন, কোন কোন বিধান আমাদের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। কোন বিধান পালন করা সকলের জন্যে সহজ হবে। কোন বিধান বিশেষ শ্রেণিকে লাভবান হতে বাধা দেবে। আর মানুষ আমার কিংবা তোমার বিবেকপ্রসূত স্ট্যান্ডার্ড মানতে বাধ্য না হলেও, স্রষ্টার স্ট্যান্ডার্ড মানতে অবশ্যই বাধ্য। কেননা স্রষ্টা তাকে সৃষ্টি করেছেন।’
‘স্রষ্টার স্ট্যান্ডার্ডের নাম কী?’
‘আল-কোরআন। মহান স্রষ্টার সেই স্ট্যান্ডার্ডের নাম হলো আল-কোরআন। কোরআনের আরেক নাম হলো আল-ফুরকান। ইংরেজিতে যাকে বলে দ্যা স্ট্যান্ডার্ড। আমরা মুসলিমরা সকল কাজ, এই স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে মেপে থাকি। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা এই স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে বিবেচনা করি। তাই দেখবে, ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই পাল্টায় না। সব সময় একই থাকে। সময়ের পরিবর্তনে খারাপ কাজগুলো মানুষ ভালো মনে করতে থাকলেও, ইসলাম কখনোই সেটাকে ভালো মনে করে না। আবার ভালো কাজও যদি খারাপ হয়ে যায়, তবুও ইসলাম সেটাকে খারাপ মনে করে না। কেননা, সত্য সব সময় ধ্রুব। আর মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তনশীল। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনশীল। বিবেক পরিবর্তনশীল। তাই ব্যক্তির বিবেক কখনো সবক্ষেত্রে ভালো-মন্দ নির্ণয়ের স্ট্যান্ডার্ড হতে পারে না।’

ফারিসের কথা শেষ হতেই, আসিফ কিছু না বলে—মাথা নিচু করে চলে গেল। ফারিস বিষয়টা এমনভাবে বোঝাল যে, আসিফের দ্বিমত করার সুযোগ রইল না। আমি ওকে আটকাতে যাব, ফারিস আমাকে বাধা দিলো।
আসিফ চলে যাওয়ার পর ফারিস বলল, ‘নাস্তিকতার ভাইরাস আজ ঝড়ো হাওয়ার মতো বাহিত হচ্ছে। আমাদের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিগুলোকে সংক্রমিত করছে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন ব্লগ, পেইজ, ওয়েবসাইট, এনজিও প্রতিনিয়ত এ ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। জানি না শেষতক কী হয়।’
‘আমাদের কিছু করা দরকার না?’
‘হ্যাঁ দোস্ত। অবশ্যই দরকার। এই ভাইরাস থেকে কওমকে বাঁচানো দরকার।’
ফারিসের সাথে আরও কিছুক্ষণ কাটাতে পারলে ভালো হত। নাস্তিকতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যেত। তা আর সম্ভব হলো না। ফারিস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উঠতে হবে দোস্ত। আন্টির হাতের খিচুড়ি অন্যদিন খাব ইনশাআল্লাহ।’

তথ্যসূত্র :

1.) “The unlawful use of force and violence against persons or property to intimidate or coerce a government, the civilian population or any segment thereof, in furtherance of political or social objectives.” [Code of Federal Regulations, (28 C.F.R. Section: 0.85)]

2.) St.phane Courtois, Nicolas Werth, Jean-Louis Pann., Andrzej Paczkowski, Karel Bartosek, Jean-Louis Margolin, The Black Book of Communism, (Harvard University Press, 1999)