নারীবাদী মানসিকতাসম্পন্ন খবিসদের ধারণা হলো, হিজাব মানে মাথা ঢাকার একটুকরো কাপড়। সেটা চিত্তাকর্ষক, চোখধাঁধানো কিংবা অমুসলিমদের অনুকরণে করা হলো কি না, এই ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই কোনো। যাচ্ছেতাই হলেই হলো। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমি জানি, তোমার মধ্যেও এই ধারণা কাজ করে। ইয়া লম্বা ত্যানা মাথায় পেঁচিয়ে উটের কুঁজের মতো বানাতে পারলেই হিজাবের বিধান আদায় হয়ে গেছে বলে মনে করো। অথচ এর দ্বারা তোমার দুইটা গুনাহ হয়েছে। প্রথমত, তুমি হিজাবের বিধানকে বিকৃত করেছ। দ্বিতীয়ত, তুমি জাহান্নামীদের মতো সেজেছ। যারা নিজেদের মাথাকে উটের কুঁজের মতো করে সাজায়, তারা জাহান্নামী। নবি ﷺ বলেছেন,
“... যাদের মাথার খোপা বুখতি উটের পিঠে-থাকা উঁচু কুঁজের মতন, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি অনেক দূর থেকে পাওয়া যায়।”[1]
চিন্তা করেছ, এই ধরনের সাজসজ্জা গ্রহণের পরিণাম কত ভয়াবহ! অথচ এটাই তোমার নিত্যদিনের পোশাক। এটাকেই হিজাব বলে চালানোর চেষ্টা করো। এটাকে বড়োজোর স্কার্ফ বলা যেতে পারে। কিন্তু হিজাব নয়। হাত আমাদের দেহের একটা অংশ। কোনোভাবেই হাত মানে পুরো দেহ নয়। তেমনি স্কার্ফ হিজাবের একটি অংশ। এটা পরা মানেই হিজাবি হয়ে যাওয়া নয়।
একখণ্ড কাপড় মাথায় জড়ালেই হিজাবের নির্দেশ পালন হয়ে যায় না। হিজাব একটুকরো বস্ত্রের নাম নয়। বরং তা হলো নারী ও পুরুষের মধ্যিকার এক বিশেষ অবস্থার নাম। যার দ্বারা একটি অন্তরাল তৈরি হয় দুজনার মধ্যে। মিটে যায় অবাধ মেলামেশা ও পাপাচারের রাস্তা। নারী-পুরুষের মধ্যে এ হিজাব/আড়াল/অন্তরাল/পর্দা কার্যকর করার জন্য কুরআনে বেশকিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশ মেনে চলার নামই হিজাব বা পর্দার বিধান পালন।
- নারীরা সাধারণত ঘরে থাকবে। বিনা প্রয়োজনে বাইরে বেরোবে না। প্রয়োজনবশত বাইরে গেলে নিজেদের প্রদর্শনী করবে না জাহিলি যুগের মতো। [সূরা আহযাব, ৩৩ : ৩৩]
- গায়রে মাহরাম[2] পুরুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় কোমল স্বরে কথা বলবে না। কারণ এভাবে কথা বললে কারও কারও মন আকৃষ্ট হতে পারে। এ দিকটা খেয়াল রেখে ন্যায়সঙ্গত কথাবার্তা বলা যাবে। [সূরা আহযাব, ৩৩ : ৩২]
- পুরুষরা নারীদের কাছে কিছু চাইলে সরাসরি চাইবে না। বরং উভয়ের মাঝখানে একটি হিজাব বা অন্তরাল থাকতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো উভয়কে অশ্লীল চিন্তা থেকে পবিত্র রাখা। [সূরা আহযাব, ৩৩ : ৫৩]
- ঘরের বাইরে চলাফেরার সময় নারীরা একটি জিলবাব বা বড়ো চাদর দিয়ে নিজেদের পুরো দেহ ঢেকে রাখবে। যাতে বোঝা যায়—অশালীন জীবনাচরণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে কুচিন্তা-লালনকারীরা তাদের বিরক্ত করার সুযোগ পাবে না। [সূরা আহযাব, ৩৩ : ৫৩]
- খিমার বা ওড়না দিয়ে বুক ঢেকে রাখবে। [সূরা নূর, ২৪ : ৩০]
- নারী ও পুরুষ উভয়ে নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখবে। কেননা, অন্তরকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। [সূরা নূর, ২৪ : ৩০]
- গায়রে মাহরাম পুরুষদের সামনে নারীরা নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। তবে নিজে থেকে প্রকাশ না করলেও যে সৌন্দর্য এমনিতেই প্রকাশ হয়ে যায় (যেমন : দৈহিক উচ্চতা, বোরখার রঙ, চলার স্বাভাবিক ভঙ্গী ইত্যাদি) সেটির জন্য পাকড়াও করা হবে না। [সূরা নূর, ২৪ : ৩০]
- অন্যদের আকৃষ্ট করার জন্য পা দুলিয়ে হাঁটবে না। [সূরা নূর, ২৪ : ৩০]
- নারী-পুরুষ সবাই নিজেদের গোনাহের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করবে। [সূরা নূর, ২৪ : ৩০]
কুরআন মাজীদে হিজাব বা পর্দার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ হিজাব মানে মাথায় একটুকরো কাপড় জড়ানো নয়। বরং নারী-পুরুষের মাঝখানে একটি অন্তরাল তৈরি করা। যাতে করে উভয়ের মন পরিচ্ছন্ন থাকে। একে অপরের দিকে আকৃষ্ট না হয়। ঘরের বাইরে গেলে পর্দার বৃহত্তর বিধান পালনের ক্ষেত্রে দুটি পোশাকি মাধ্যম হলো খিমার ও জিলবাব।
হিজাব বলতে কী বোঝায়, তা এখনও পরিষ্কার নয় তোমার কাছে। পর্দা বলতে অবরোধপ্রথা বোঝো তুমি। তুমি মনে করো, অন্ধকুঠুরিতে নারীকে আবদ্ধ করে রাখার পুরুষালি কৌশল হলো পর্দা। তাই তো পর্দাকে এড়িয়ে চলো। তুমি ভাবো, পর্দা নিজের কাছে। পর্দার জন্য বিশেষ কোনো বিধান বা বিশেষ কোনো পোশাকের প্রয়োজন নেই। মন ভালো, তো সব ভালো। আর বেপর্দা চলাফেরা করাটা দোষের কিছু না।
বোন আমার! তোমার ধারণাগুলো ভুল। হিজাব শুধু পোশাকের কোনো আবরণ নয়। বরং সামগ্রিক একটি জীবনব্যবস্থা। একটি আদর্শের প্রতিফলন। শিষ্টাচারের পরিচায়ক। ইসলামি মূল্যবোধের আইডিকার্ড। নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক এবং নারীর প্রতি সমাজের সহিংস মনোভাব রোধের বিভিন্ন কৌশল রয়েছে এর মধ্যেই। হিজাব শব্দটা কেবল পোশাকি পর্দাকেই নির্দেশ করে না। এটি আসলে ব্যাপক অর্থ বহন করে। কলুষতামুক্ত সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের বিভিন্ন বিধানাবলির বাস্তবায়নকেই মূলত হিজাব বলা হয়। নানাবিধ দিক এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন :
- সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটতে পারে এরূপ সকল কথা বা কর্ম থেকে বিরত থাকা।
- অশ্লীলতার প্রচার বা প্রসারমূলক কাজে লিপ্তদেরকে শাস্তি প্রদান করা।
- সন্তানদেরকে পবিত্রতা ও সততার ওপর প্রতিপালন করা এবং অশ্লীলতার প্ররোচক বা অহেতুক সুড়সুড়ি মূলক সকল কথা বা দৃশ্য থেকে তাদেরকে দূরে রাখা।
- কারও আবাসগৃহে বা বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি গ্রহণের ব্যবস্থা এবং বিনা অনুমতিতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা।
- নারী-পুরুষের শালীন পোশাক পরিধান করা।
- বিপরীত লিঙ্গের মধ্যিকার অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা।
- প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়দের বিয়ে দেওয়া। বিধবা ও বিপত্নীক ব্যক্তিদের জন্যে বিয়ের ব্যবস্থা করা।
- দাম্পত্য জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতা বজায় রাখা।[3]
এসকল দিকের সমন্বয়েই হিজাব পূর্ণতা পায়। মাথায় একটুখানি কাপড় জড়ানোকে হিজাব বলে চালিয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিধানের সাথে প্রতারণা। এটা পশ্চিমাদের শেখানো হিজাব। যারা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইসলামকে ব্যাখা করতে চায়, তারা মূলত গোমরাহিতে লিপ্ত। পর্দার বিধানকে বিকৃত করে অশ্লীলতার প্লাবনে সমাজকে যারা ছয়লাভ করে দিতে চায়, তাদের জন্যে ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যারা চায় মুমিনদের সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক, তারা দুনিয়ায় ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।”[4]
বোন আমার! হিজাবের বিধানকে বিকৃত করার আগে নতুন করে আবার ভাবো। মুসলিম দাবি করার পর নিজের মুখ দিয়ে এমন সব কথা বের কোরো না, যারা দ্বারা ঈমানের শেষ বিন্দুটুকুও বিলীন হয়ে যায়। তুমি তো ঈমানদার। তোমার মুখ দিয়ে কেন এমন কথা বেরোবে, যা আল্লাহর শত্রুদেরকে সন্তুষ্ট করে? কেন তুমি হিজাবের ধারণাকে বিকৃত করবে সমাজে?
মনে রেখো, হাজারটা বিড়াল মিলেও একটা সিংহের সমান হতে পারবে না। তুমি যত বড়ো কাপড়ই মাথায় প্যাঁচাও না কেন, ওটাও কখনও হিজাবের আওতায় আসবে না। হিজাব সেটাই, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নির্ধারণ দিয়েছেন। যতই জোড়াতালি দিয়ে স্কার্ফকে হিজাব বানানোর চেষ্টা করো না কেন, কিচ্ছুটি আসে যায় না। তোমার ওই মনগড়া ব্যাখ্যার কানাকড়িও মূল্য নেই ইসলামে। মূল্য নেই উটের কুঁজ সদৃশ মস্তকপট্টির। এগুলো দিয়ে জান্নাত কামানোর স্বপ্ন দেখো না।
[1] মুসলিম, ৭০৮৬।
[2] নারীদের জন্যে মাহরাম হলো : বাবা, ছেলে, ভাই, নানা, দুধ ভাই, মামা, ভাতিজা, ভাগিনা, চাচা, দাদা, শ্বশুর, সৎ ছেলে, দুধ ছেলে, মেয়ের জামাতা। এর বাইরে যারা আছে, সবাই গায়রে মাহরাম।
পুরুষের জন্যে মাহরাম হলো : মা, মেয়ে, বোন, নানি, দাদি, দুধ মা, খালা, ভাতিজি, ভাগ্নি, ফুপু, সৎ মা, শাশুড়ি, দুধ মেয়ে, পুত্রবধূ।
[3] ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে পোশাক, পর্দা ও দেহ-সজ্জা, পৃষ্ঠা : ২৪৫-২৪৬; ইসলামে পর্দা, পৃষ্ঠা : ৫।
[4] সূরা নূর, ২৪ : ১৯।